সংসার কী তা আমি বুঝি না। সংসারে যে এতো জ্বালা তা জানা ছিল না।
রান্নাবান্না, বাড়ির কাজকর্ম, শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীসহ তার পরিবারের লোকজনের মন জোগানো আমি বুঝিও না। আমার সব কাজকর্ম ছিল বাবা-মা’র ওপর নির্ভরশীল। স্বামীর সংসারের ছক বাধা বন্দি জীবনের দুর্বিসহ কষ্ট আমার আর সহ্য হচ্ছে না। মন চায় আবারো স্কুলে যাই। খেলাপড়া শেষ করে চাকরি করি, মানুষের মতো মানুষ হব। সংসার বুঝেই তখন সংসার করব।’
উপরোক্ত কথাগুলো বলে কান্নায় ভাসছিলেন বাল্যবিয়ের যাতাকলে পিষ্ট সুমনা আক্তার সুমি নামের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী।
সুমি মেহেরপুর গাংনী উপজেলার মাইলমারী গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফার মেয়ে। মাস চারেক আগে তার বিয়ে হয় গাংনীর চৌগাছ গ্রামের আব্দুস সামাদের ছেলে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। সুমির মানসিক বিষয়টি স্বামীর পরিবার টের পেয়ে তারাও মুক্তির পথে এগিয়ে এসেছেন। বুধবার বিকেলে তারা সুমিকে নিয়ে গাংনী পৌরসভা কার্যালয়ে মেয়র আহম্মেদ আলীর কাছে আসেন। সেখানেই সুমি জানায় তার আকুতির কথা।
সুমির শ্বশুর আব্দুস সামাদ জানান, উভয় পরিবারের দেখাশোনা ও কথাবার্তার মাধ্যমে চার মাস আগে তার ছেলে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সুমির বিয়ে হয়। নববধূকে ঘরে তুলে সংসার শুরু হলেও প্রথম দিন থেকেই খুশি হতে পারেননি তারা। তবে মেয়ের মতো আপন করে নেয়ার শত চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে সমাধানের লক্ষ্যে পৌর মেয়রের দ্বারস্থ হন।
তিনি আরো জানান, মাইলমারী গ্রামের পল্লি চিকিৎসক শহিদুল ইসলামের ছেলে মেহেরপুর সরকারি কলেজের ছাত্র জনির সঙ্গে সুমির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিষয়টি টের পেয়ে সুমির বাবা শহিদুল ইসলামের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি ফিরিয়ে দেন। এতে রাগে ক্ষোভে অভিমানে মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুমির বাবা। তবে বিয়ের আগে বিষয়টি তাদের জানানো হয়নি। বিয়ের পরও মোবাইলে জনি তাকে বিরক্ত করতো। এসব বিষয় নিয়ে স্বামী সাইফুল ইসলামসহ পরিবারের লোকজন অতিষ্ট হয়ে ওঠে। তবে সুমির দাবি এখন জনির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
গাংনী পৌর মেয়র আহম্মেদ আলী জানান, বিষয়টি সমাধানের জন্য সুমির বাবাকে পৌরসভা কার্যালয়ে আসার জন্য খবর দেয়া হয়। কিন্তু তিনি উপস্থিত হননি। যেহেতু তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনের সংসার করতে চাইছে না তাই উভয়পক্ষের লোকজনের লিখিত নিয়ে সুমির বাবার গ্রামের ইউপি সদস্যর জিম্মায় সুমিকে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। উভয়পক্ষের দেয়া গয়নাগাটিও ফেরত দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বসে তালাকের বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন। তবে এ ব্যাপারে সুমির বাবা কোনো মন্তব্য করেননি।
এ প্রসঙ্গে গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল আমিন বলেন, ‘সুমিকে দেখলেই সহজেই বোঝা যায় বাল্যবিয়ের কুফল। যে মেয়েটির সব কাজকর্ম এখনো তার বাবা-মা’র ওপর নির্ভরশীল তাকে সংসারের যাতাকলে পিষে কি সংসার করানো যাবে? তার সংসার করার মতো বুদ্ধি হয়নি। তার তো এখনো শিশুকালই পার হয়নি। সে কী করে টানবে সংসারের ঘানি? প্রতিদিনই এমন অনেক সুমির স্বপ্ন বাল্যবিয়ের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে মরছে। সুমিকে দেখে প্রত্যেক অভিভাবককে শেখা উচিৎ। বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে বাঁচতে সুমির এই আকুতি যেন সব বাবা-মা মনে রাখেন। সুমি যদি আবারো লেখাপড়া করতে চায় তাহলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা দেয়া যেতে পারে বলে জানালেন তিনি।
Leave a Reply